দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বরিশাল-৪ আসনের হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভেদ প্রকট আকার ধারন করেছে। বাকযুদ্ধের পাশাপাশি সরাসরি বিবাদেও জড়িয়ে পড়ছে ত্রি-গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়া আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এক পক্ষের নেতৃত্বে রয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য পংকজ দেবনাথ। অপর পক্ষের নেতৃত্বে রয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মি আহমেদ।এ পক্ষকে জেলা আওয়ামী লীগ পক্ষ অভিহিত করেছে এমপি পংকজ অনুসারী নেতৃবৃন্দরা। এছাড়াও রয়েছেন এ্যাড. আফজালুল করিম। যদিও তিনি নিরবে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন কারো প্রতি কোনো বিরুপ মন্তব্য না করেই।
গত ১৬ অক্টোবর বরিশালের হিজলায় অনুষ্ঠিত কর্মী সভায় তিন সাংগঠনিক উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা এমপি পঙ্কজের নানা সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। গত ১০ বছরে দুই উপজেলায় দলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর অন্যায়-অত্যাচার হয়েছে দাবি করে নেতৃবৃন্দ আগামী নির্বাচনে বরিশাল-৪ আসনে শাম্মী আহমেদকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি করেন। ওই কর্মীসভায় শাম্মী আহমেদ প্রধান অতিথি ছিলেন। নিজের প্রার্থী বিষয়ে কোন কথা না বললেও এ নিয়ে বুধবার তার প্রয়াত বাবা বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক মহিউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে বক্তব্য দেন বর্তমান সংসদ সদস্য পংকজ দেবনাথ। এরপর থেকে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার তিন থানা এলাকার রাজনীতি। কোনঠাসা অবস্থা থেকে বেরিয়ে শক্ত অবস্থান জানান দেয়ার চেষ্টা করছেন এমপি পংকজ দেবনাথ। আর জেলা আওয়ামী লীগ অনুসারীরা শাম্মি আহমেদকে সামনে নিয়ে আগানোর চেষ্টা করছে। দলীয় নেতার অনুসারীরা নিশ্চিত তারা দলীয় মনোনয়ন পাবেন। এর মাঝেও আরো কয়েকজন দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় হিজলা উপজেলার চেয়ারম্যান মো.বেলায়েত হোসেন ঢালীর সাথে।তিনি বলেন,বরিশাল -৪ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার যোগ্য প্রার্থী হলেন পংকজ দেবনাথ। তাকে মনোনয়ন দিলে বিপুল ভোটে তিনি জয়লাভ করবেন।স্বপক্ষের যুক্তি তুলে ধরে প্রবীন এ আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, উপজেলা নির্বাচনে তিনি বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচন করেছেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদ টিপু সিকদার ছিলেন দলীয় প্রার্থী। ভোটে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে তিনি পেয়েছিলে ২৬ হাজার ও টিপু সিকদার পেয়েছিলেন ১০ হাজার ভোট। টিপু সিকদার দুইবারের চেয়ারম্যান ছিলেন। সাধারন মানুষ যদি তাদের সমর্থন করতো, তাহলে তো ভোট পেতো। কিন্তু তাদের পক্ষে সাধারন মানুষ নেই। যারা দিতে পারে জনগন তাদের পক্ষে থাকে। পংকজ দেবনাথ সাধারন মানুষের জন্য করে। জনগন তার পক্ষে রয়েছে। উপজেলা চেয়ারম্যান বেলায়েত ঢালির দাবি দলীয় পদধারীরা না থাকলেও জনপ্রতিনিধি ও জনগন পংকজ দেবনাথের পক্ষে রয়েছেন। হিজলা উপজেলার চেয়রম্যান, সাধারন ও সংরক্ষিত ভাইস চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এমনকি ইউপি সদস্যরাও পংকজ দেবনাথের পক্ষে রয়েছে।
এমপি পংকজ দেবনাথের আরেকজন অনুসারী ও মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম ভুলু বলেন, হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ ও কাজিরহাট থানা আওয়ামী লীগ এবং সংগঠনের কোন কমিটিতে এমপির কোন অনুসারী নেই। উপজেলা চেয়ারম্যান, সাধারন ও সংরক্ষিত ভাইস চেয়ারম্যান, পৌর কাউন্সিলর ও ১৬ ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরা এমপি পংকজ অনুসারী ছিলেন। এর মধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান, ৮ ইউপি চেয়ারম্যানসহ সিংহভাগ জনপ্রতিনিধি এখন তার পংকজ এমপির পক্ষে নেই।তাই এখন তিনি ও তার অনুসারীরা সকলে কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন জানিয়ে ভুলু বলেন, বর্তমানে বরিশাল-৪ আসনে পাঁচ নেতা চেষ্টা করছেন। তারা হলেন বর্তমান এমপি পংকজ দেবনাথ, শাম্মী আহমেদ, এ্যাড. আফজালুল করিম, মো: মইদুল ইসলাম, শাহআলম মুরাদ।
এমপি পংকজের একনিষ্ঠ অনুসারী হিসেবে পরিচিত ভুলু বলেন, যিনি দলের মনোয়ন পাবেন তার পক্ষে নেতাকর্মীসহ তিনি কাজ করবেন। বর্তমানে দলীয় প্রার্থী হিসেবে শাম্মী আহমেদ অনেকটা এগিয়ে রয়েছেন দাবি করে ভুলু বলেন, আগে তার এতটা পরিচিতি ছিলো না। নিয়মতি মেহেন্দিগঞ্জেও আসতো না। এখন নিয়মিত আসছেন, দলীয় কর্মসুচীতে অংশ নিচ্ছেন। এ কারনে তার অনুসারীর সংখ্যাও বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন ভুলু।মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা সুভাষ চন্দ্র সরকার বলেন, এমপি পংকজ দেবনাথ কেন্দ্রীয় রাজনীতি করতেন। তার সাথে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সু-সম্পর্ক রয়েছে। তার রাজনীতির ধরন, উন্নয়নসহ দল পরিচালনা আলাদা। যা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছাড়া অন্য কেউ মেনে নিতে পারে না। পংকজ দেবনাথ আবারো দলীয় মনোনয়ন পেলে জয়ী হবে। তখন প্রধানমন্ত্রী তাকে যদি বড় কোন দায়িত্ব দেয়, তাহলে জেলার রাজনীতির নিয়ন্ত্রন পংকজ দেবনাথ এমপির হাতে চলে যাবে। এ চিন্তা করে পংকজ দেবনাথকে মাইনাস করার মিশন শুরু করেছে। প্রবীন এ নেতা বলেন, তাই জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ শাম্মীকে নিয়ে নেমেছেন। শাম্মী মনোনয়ন পেলে হেরে যাবে। তখন হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার নেতৃবৃন্দ নিজেদের মতো করে চলতে পারবে। স্থানীয় স্বার্থ উদ্ধারের কারনে পংকজ এমপির বিরুদ্ধে নেমেছে।
হিজলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদ টিপু বলেন, আমরা চাই স্বচ্ছ মানুষ। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ স্বচ্ছ মানুষ। তাই প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী তৃতীয়বারের মতো এ পদে রেখেছেন তাকে। তাই আমরা শাম্মী আহমেদকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে চেয়েছি। তার বাবা ভালো মানুষ ছিলেন জানিয়ে টিপু সিকদার বলেন, হিজলা উপজেলার আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মাঝে বিভেদ ও সংঘাত সৃষ্টি করেছেন এমপি পংকজ। তিনি একজন মৃত মানুষকে নিয়ে যা বলেছেন, একজন সংসদ সদস্য হিসেবে এটা উচিত হয়নি। এমপি পংকজের এ বক্তব্য নিয়ে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা ক্ষুদ্ধ হয়েছেন। এ নিয়ে তারা বিক্ষোভ সমাবেশ করতে চায়। এতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে। দলের বদনাম হবে। চেষ্টা করছি এসব থেকে সকলকে বুঝিয়ে শান্ত করতে। কিন্তু নেতাকর্মীদের কতটুকু শান্ত করতে পারবো জানি না মন্তব্য করে টিপু সিকদার বলেন, এমপি পংকজ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করিয়েছে, তাদের হয়রানি করেছে। তাই কেউ তার পক্ষে নেই।
নাম প্রকাশ করার না শর্তে মেহেন্দিগঞ্জ ও হিজলা উপজেলার নেতারা জানিয়েছেন, দুই উপজেলায় এখন এমপি অনুসারীরা এখন কোনঠাসা হয়ে রয়েছে। বর্তমানে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগ অনুসারীরা দুই উপজেলায় শক্ত অবস্থানে রয়েছে। এর নেতৃত্বে রয়েছেন হিজলায় উপজেলা সভাপতি টিপু সিকদার, মেহেন্দিগঞ্জে পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামালউদ্দিন খান। মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র মো. কামালউদ্দিন খান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমপি পংকজ দেবনাথকে দল থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। সে দলের কেউ না। তার সম্পর্কে কোন মন্তব্য করবো না। এক পর্যায়ে কামাল খান বলেন, প্রয়াত মহিউদ্দিন আহমেদ বর্ষিয়ান রাজনৈতিক নেতা। দীর্ঘদিন বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক ছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত এ নেতার সম্পর্কে একজন সংসদ সদস্য এ ধরনের কথা বলতে পারে না। তিনি সত্য মিথ্যা যা ইচ্ছা তাই বলে যাচ্ছেন। তার সম্পর্কে কোন মন্তব্য করবো না। বরিশাল-৪ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি এ্যাড. আফজালুল করিম বলেন, শাম্মী পংকজকে নিয়ে আর পংকজ শাম্মী সম্পর্কে কি বলেছে তা নিয়ে আমি কোন মন্তব্য করবো না। কাঁদা ছোড়াছুড়ির রাজনীতি আমি করি না। আমি বর্তমান সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড নিয়ে প্রচার প্রচারনা করি। উন্নয়ন কর্মকা- যদি সাধারন মানুষের কাছে তুলে না ধরা যায়, তাহলে মানুষ কেন ভোট দিবে। আমি উন্নয়ন কর্মকা- তুলে ধরে ভোট চেয়ে নিজের প্রার্থীতা তুলে ধরছি। মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক শাহাব আহমেদ বলেন, এমপি পংকজ কি বলছে না বলছে তা নিয়ে কোন মন্তব্য করবো না। বরিশালের মানুষ জানে মহিউদ্দিন আহমেদ কে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের জন্য মহিউদ্দিন আহমেদ কি করেছেন। আওয়ামী লীগের সকল কর্মকান্ড নগরীর আলেকান্দার বাসায় পরিচালিত হতো। সাধারন সম্পাদক জানান, তার বোন শাম্মী আহমেদ বরিশাল বিএম কলেজে ছাত্রলীগের রাজনীতি করেন। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছিলেন। ২০০১ সালে কেন্দ্রীয় কমিটিতে আন্তজার্তিক সম্পাদক বিষয়ক উপ কমিটির সদস্য হন। ২০১৭ সাল থেকে আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পদে রয়েছেন। এদিকে ঘোষনা না দিলেও বরিশাল-৪ আসন থেকে দুইবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক ও চেয়ারম্যান মো. মইদুল ইসলামও দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। দলীয় নেতাকর্মীদের কাঁদা ছোড়াছুড়িতে না জড়িয়ে নিরবে প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় নেতৃবেন্দদের সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করছেন।