মো.উজ্জল শেখ,নড়াইল প্রতিনিধিঃ- আজ মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) বিশ্ব বরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের ২৯তম মৃত্যু বার্ষিকী। দিনটি যথাযথভাবে পালন উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি,এসএম সুলতান ফাউন্ডেশন, জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আজ (মঙ্গলবার) সকাল ৯টায় চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের সমাধিতে পুস্পস্তবক অর্পণ,সকাল সাড়ে ৯টায় সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালায় আর্টক্যাম্প, সকাল ১০টায় এসএম সুলতান শিশুস্বর্গে শিশুদের লেখা পত্র প্রদর্শনী ও পাপেট শো,বিকেল সাড়ে ৩টায় জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে আলোচনা সভা ও আদম সুরত প্রদর্শনী,বিকেল ৫টায় জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে পালাগানের আসর।
এছাড়া সকালে শিল্পী সুলতানের রুহের মাগফেরাত কামনা করে কোরআনখানি ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। জেলা প্রশাসক ও সুলতান ফাউন্ডেশনের সভাপতি মোহাম্মদ আশফাকুল হক চৌধুরী জানান, চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের ২৯তম মৃত্যুবার্ষিকী যথাযথভাবে পালনের লক্ষ্যে যাবতীয় প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।বিখ্যাত চিত্রকর এসএম সুলতান ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ আগস্ট তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত তথা বর্তমান বাংলাদেশের নড়াইল জেলার মাছিমদিয়া গ্রামে এক সাধারণ দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা শেখ মোহাম্মদ মেছের আলী পেশায় ছিলেন রাজমিস্ত্রী। মায়ের নাম মাজু বিবি। শৈশবে পরিবারের সবাই তাকে লাল মিয়া বলে ডাকতো।
অল্পদিনের মধ্যেই লাল মিয়া মা হারা হন। ছোটবেলা থেকেই বাবাকে রাজমিস্ত্রির কাজে সহযোগিতা করার পাশাপাশি ছবি আঁকার প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিল তাঁর। দরিদ্র রাজমিস্ত্রির একমাত্র পুত্র লাল মিয়া ১৯২৮ সালে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন।
এরপর তিনি চারুকলার ওপর পড়াশোনা করার জন্য কলকাতা যেতে চাইলে তাঁর পরিবার রাজি হয়নি। কিন্তু স্থানীয় জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়বাহাদুরের সহযোগিতায় এই বিস্ময়কর প্রতিভাবান শিল্পী ১৯৩৮ সালে কলকতায় চলে যান।
একাডেমিক যোগ্যতা না থাকা সত্তে¡ও কলকাতা আর্ট স্কুলের গভনির্ং বডির সদস্য শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সুপারিশে ১৯৪১ সালে র্আট স্কুলে ভর্তি হন। তিনি তাঁর নতুন নাম রাখলেন শেখ মুহম্মদ সুলতান তথা এস.এম.সুলতান। ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতার সরকারি আর্ট ইনস্টিটিউটের চিত্রকলার শিক্ষা গ্রহণ করেন। সমাজসেবামুলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের জন্য সুলতান ১৯৪৩ সালে ‘খোকসার’ আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯৪৬ সালে মিসেস হাডসন নামে কানাডীয় এক মহিলার উদ্যোগে ভারতের শিমলায় প্রদর্শিত হলো তাঁর একক চিত্র। এই প্রদর্শনীই তাঁর শিল্পীজীবনের প্রথম স্বীকৃতি। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে তাঁর মোট বিশটি একক প্রদর্শনী হয়। এছাড়া লন্ডনে হ্যামস্টীডে ভিক্টোরিয়া এমব্যাংকমেন্টে পাবলো পিকাসো, মাতিস, সালভাদর দালি, ব্রাক, ক্লি প্রমুখ খ্যাতনামা শিল্পীদের সঙ্গে যৌথ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন তিনি।
এসব একক ও সম্মিলিত প্রদর্শনীর মাধ্যমে সুলতান প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের চিত্রকলার জগতে আলোড়ন তুলেছিলেন। তাঁর ছবিগুলোতে বিশ্বসভ্যতার কেন্দ্র হিসেবে গ্রামের মহিমা উঠে এসেছে এবং কৃষককে এই কেন্দ্রের রূপকার হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আবহমান বাংলার সেই ইতিহাস-ঐতিহ্য, দ্রোহ-প্রতিবাদ, বিপ্লব-সংগ্রাম এবং বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকার ইতিহাস তাঁর শিল্পকর্মকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। উত্তাল-তরঙ্গায়িত পেশির ফুঁসে ওঠার মধ্য দিয়ে মানুষের অভ্যন্তরীণ ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ ঘটিয়ে তুলির পরশে বিশাল বিশাল ক্যানভাসের জীবন্ত রুপকার বিদ্রোহী বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের বিখ্যাত শিল্পকর্মগুলো মধ্যে আছে জমি কর্ষণ-১, জমি কর্ষণ-২ (তেল রং ১৯৮৬, ১৯৮৭), হত্যাযজ্ঞ (তেল রং ১৯৮৭), মাছ কাটা (তেল রং ১৯৮৭), জমি কর্ষণে যাত্রা-১ এবং ২ (তেল রং ১৯৮৭, ১৯৮৯), যাত্রা (তেল রং ১৯৮৭), ধান মাড়াই
(তেল রং ১৯৯২), গাঁতায় কৃষক (তেল রং ১৯৭৫),প্রথম বৃক্ষ রোপন (তেল রং ১৯৭৬ ), চর দখল (তেল রং ১৯৭৬)
পৃথিবীর মানচিত্র (তেল রং) ইত্যাদি।
তাঁর আরেকটা চমৎকার গুণ ছিল তিনি অনবদ্য বাঁশি বাজাতেন। এই উপমহাদেশের গুটিকয় অসামান্য শিল্পীর মাঝে সবচাইতে জমকালো ছিলেন সুলতান। তিনি এশিয়ার কন্ঠস্বর। সুলতান নাড়ির টানে বিশ্বভ্রমণ শেষে ১৯৫৩ সালে ইউরোপ থেকে আবার নড়াইলের মাটিতে ফিরে এলেন। চিরকুমার সুলতান একজন অসম্ভব প্রাণীপ্রেমী মানুষ ছিলেন। সুলতান জেলার চাঁচুড়ী পুরুলিয়ায় মামার বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘নন্দন কানন-দি স্কুল অব ফাইন আর্টস’, যশোরের চাঁচড়া রাজবাড়ীতে ‘ইন্টেলেকচার কলোনী’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
১৯৭৩ সালে তিনি ‘চারুকুঠি’ নামে যশোরে একটি (চারুকলা) ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৯ এ প্রতিষ্ঠা করলেন ‘নড়াইল কুড়িগ্রাম ফাইন আর্টস ইনস্টিটিউশন’। ঢাকার সোনার গাঁয়েও তিনি একটি আর্টস স্কুল খুলেছিলেন। যশোর মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ের পুরাতন ভবনে ‘দি একাডেমী অব ফাইন আর্টস’ নামে একটি চিত্রকলার স্কুল খোলেন। চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের ৭০ বছরের বোহেমিয়ান জীবনে প্রাকৃতিক পরিবেশে শিশুদে পড়াশোন, ছবি আঁকা গান শেখা ইত্যাদি মিলিয়ে শিশুর স্বর্গনাম,প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তিনি।কালোতীর্ণ এই চিত্রশিল্পী ১৯৮২সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে,ম্যান অফ অ্যাচিভমেন্ট,এশিয়া ইউক পত্রিকা থেকে এশিয়া পদক লাভ করেন,একই বছরের সুলতান একুশে পদক লাভ করেন।
১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকারে, রিসিডিন্সিয়াল,আর্টিস্ট হিসেবে স্বীকৃতি ১৯৮৬সালে চারুশিল্পে সংসদ সম্মাননা, ১৯৯৩সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হলেন।সুলতানের শেষ বয়সে এসে শিশুদের বিনোদনের জন্য,৬০ফুট দৈর্ঘ্য একটি প্রমোথ তরী, বজরা,শিল্পী প্রায় শিশুদের নিয়ে বজরায় চিত্রা নদীতে ঘুরে বেড়াতেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছবি আঁকা শেখাত। অবশেষে শিল্পী ১৯৯৪ সালের ১০অক্টোবর চিকিৎসাধীন অবস্থায় যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।